মিলাদ + নবী দুটি শব্দ একত্রে মিলে মিলাদুন্নবী বলা হয় । সমাজে ‘মিলাদ’ এর তিনটি শব্দ প্রচলিত আছে মিলাদ, মাওলিদ ও মাওলূদ । ‘মিলাদ’ অর্থ জন্মের সময়, ‘মাওলিদ’ অর্থ জন্মের স্থান, ‘মাওলূদ’ অর্থ সদ্যপ্রসূত সন্তান । আর ‘নবী’ শব্দ দ্বারা বুঝায় হুজুর (সঃ) কে । শাব্দিক অর্থে ‘মিলাদুন নবী’ বলতে হুযুর (সঃ) এর বিলাদত শরীফ বা জন্মবৃত্তান্তকে বুঝানো হয়ে থাকে । মিলাদ তথা স্থান বা কালবাচক বিশেষ্য । যেমন মীছাক, মীকাত, মীয়’আদ ইত্যাদি শব্দগুলো একইভাবে ইসমে যরফ তথা স্থান বা কালবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় । বিভিন্ন অভিধানে মীলাদ শব্দটির অর্থ কিভাবে লিখা হয়েছে তা নিম্নে উল্লেখ করছি-

• আল্লামা ইবনে মানযুর আল আফরীকি (মৃতঃ ৭১১ হিঃ) লিখেছেনঃ
অর্থাৎ লোকটির মিলাদঃ যে সময় সে জন্মগ্রহন করেছে সে সময়ের নাম।

• গিয়াছুল লুগাতে লিখিত আছেঃ
মিলাদ শব্দটির মীম অক্ষর যের বিশিষ্ট যার অর্থঃ জন্মকাল।

• মুন্তাখাব অভিধানে লিখিত আছেঃ
নবজাতক শিশু, জন্মকালীন ঘটনা, জন্মের সময়কাল।

• ইংরেজী ও আরবী ডিকসনারীতে আছে
‘মিলাদ’ অর্থঃ birth (process of being born, coming into the world) অর্থাৎ পৃথিবীতে আগমনের সময় ।

* ফায়েদাঃ

আমরা দেখলাম মিলাদুন্নবী অর্থঃ হুজুর (সঃ) এর জন্মের সময় বা জন্মকালীন ঘটনা । আমরা বিভিন্ন অভিধান খুঁজে দেখলাম যে, মিলাদ শব্দটি কে কোন অভিধানবেত্তা ইসমে আ’লাহু তথা যন্ত্রবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহার করেন নাই । যারা এমনটি বলেন, মূলতঃ তা নবীর সাথে বেয়াদবী বৈ কিছুই নয়।

• মিলাদের পারিভাষিক অর্থ

১) আল্লামা মোল্লা আলী আল ক্বারী (রহঃ) তার বিখ্যাত কিতাব “আল মাওরিদুর রাবী” তে বলেন

মিলাদ বলতে নবীর জন্মবৃত্তান্ত তার মুজিযাসমূহ ও সিরাতের আলোচনার জন্য একত্রিত হওয়া, আর যথাযথ প্রশন্সাসহ তার প্রতি দরুদ ও সালাম পড়া । জীবিত ও মৃতের জন্য দোয়া, অতঃপর তাবাররুক (খাবার) আয়োজন করে মানুষের অন্তরে নবীর জন্মে আনন্দিত হওয়া।

২) মিলাদুন্নবী অর্থ হচ্ছেঃ

তার জীবনকালের ঘটনাবলী, সানা সিফাত, মাতৃগর্ভে অবস্থানকালীন অলৌকিক ঘটনাবলী, তার বংশ পরিচয়য়, হালিমা (রাঃ) এর ঘরে প্রতিপালিত হওয়ার ঘটনা আলোচনার নামই মিলাদ ।

৩) প্রচলিত মিলাদ বলতেঃ

কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরীফ পাঠ, তাওয়াল্লুদ বা জন্মকালীন ঘটনা মজলিস করে আলোচনা করা, দাঁড়িয়ে সালাম, কাসিদা বা প্রশংসামূলক কবিতা, দোয়া মুনাজাত ও তাবাররুক বিতরণ ইত্যাদির সামষ্টিক রূপ ।

আমরা মিলাদের পরিচয়ে যা বুঝতে পারলাম এখন দেখব তা কতটুকু শরীয়াহ সমর্থিত তা পর্যালোচনা করার প্রয়াস পাব ।

* মিলাদ শব্দটির ব্যবহার

মিলাদ শব্দটির মূল অক্ষর হচ্ছে و + ل + د) ولد) । আমরা দেখব কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফে মূল অক্ষরে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে কিনা ।

* কোরআন মজীদে

وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدتُّ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا

আর শান্তি বর্ষিত হোক আমার উপরে যে দিন আমার জন্ম হয়েছিল, আর যে দিন আমি মারা যাব । আর যে দিন আমাকে পুররুত্থিত করা হবে জীবিত অবস্থায় ।

ফায়েদাঃ

আমরা দেখলাম কুরআন মাজীদে মূল অক্ষরে وَلَدَتُ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে; যার অর্থ আমি জন্ম গ্রহণ করেছি । এ শব্দটি প্রমাণ করে মিলাদের মূল অস্তিত্ব কুরআন মাজীদে বিদ্যমান ।

* হাদীস শরীফে

আমরা এখন দেখব কুরআনের পাশাপাশি হাদীস শরীফে এ শব্দটির ব্যবহার আছে কিনা । আমরা দেখি যে, জামে তিরমিযী শরীফে ميلاد ‘মিলাদ’ (জন্মের সময়) শব্দটি রাসূল (সঃ) নিজেই ব্যবহার করেছেন । যেমনঃ

১) রাসূল (সঃ) এর জন্ম সাল সম্পর্কে হযরত কায়স ইবনে মাখরামা (রাঃ) বলেনঃ

অর্থাৎ আমি ও রাসূলুল্লাহ (সঃ) দুজনেই “হাতীর বছরে” জন্মগ্রহণ করেছি । হযরত উসমান বিন আফফান (রাঃ) কুবাস বিন আশিয়ামকে প্রশ্ন করেনঃ আপনি বড় না রাসূল (সঃ) বড় ? তিনি উত্তরে বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সঃ) আমার থেকে বড়, আর আমি তার পূর্ব জন্মগ্রহণ করেছি।

২) হাদীস শরীফে আমরা আরও দেখতে পাই মহানবী (সঃ) বলেনঃ

ما من مولود الا يولد على الفطرة
অর্থাৎ প্রত্যেক শিশু তার স্বভাবের উপর জন্মলাভ করে ।
আমরা দেখলাম হাদীস শরীফে “মাওলুদ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ।

হাদিসের ইমামগণ স্ব স্ব কিতাবে মিলাদ শব্দটি ব্যবহার করেছেন

আমরা এখন দেখব কুরআন ও হাদীস শরীফের পাশাপাশি হাদিসের ইমামগণ স্ব স্ব কিতাবে মিলাদ শব্দটি ব্যবহার করেছেন কিনা । আমরা দেখি যে, আবূ ঈসা মুহাম্মদ ইবনু ঈসা তিরমিজী (রহঃ) (হিঃ ২৭৯) তার বিখ্যাত কিতাব জামে তিরমিযীর ২য় খণ্ডের ২০৩ পৃষ্ঠায় একটি শিরোনামে লিখেন-

باب ما جاء فى ميلاد النبى صلى الله عليه وسلم অর্থাৎ যা রাসূল (সঃ) এর জন্ম সম্পর্কে এসেছে । এখানে তিনি ‘মিলাদ’ শব্দটি রাসূল (সঃ) এর জন্মবৃত্তান্ত বুঝাতে ব্যবহার করেছেন ।

অনুরূপভাবে ইমাম বায়হাকী (রহঃ) (ওফাত ৪৫৮ হিঃ) তার বিখ্যাত সিরাত সংক্রান্ত হাদিসের কিতাব ‘দালায়েলুন নবুওয়ত” নামক কিতাবের ১ম খণ্ডের ৪৯ পৃষ্ঠায় ابواب ميلاد رسول الله শীর্ষক একটি অধ্যায় এনেছেন । যেখানে তিনি রাসূল (সঃ) এর জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করেছেন ।

কোরআনের আলোকে মিলাদ শরীফঃ ১ নং আয়াতঃ

এবং স্মরণ করুন! যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করবো, অতঃপর তাশরীফ আনবেন তোমাদের নিকট রসূল, যিনি তোমাদের কিতাবগুলোর সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁকে সাহায্য করবে। এরশাদ করলেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ সম্পর্কে আমার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলে?’ সবাই আরয করলো, ‘আমরা স্বীকার করলাম।’ এরশাদ করলেন, ‘তবে (তোমরা) একে অপরের উপর সাক্ষী হয়ে যাও এবং আমি নিজেই তোমাদের সাথে সাক্ষীদের মধ্যে রইলাম।’ সুতরাং যে কেউ এর পর ফিরে যাবে তবে সেসব লোক ফাসিক — সূরা আল ইমরান আয়াত ৮১, ৮২



সৌজন্যে
“একরামিয়া প্রচার সংস্থা”
মিঠাপুকুর,রংপুর, বাংলাদেশ।